বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র চার বছরের মাথায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে দলের মানুষদের ষড়যন্ত্রকেই দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যায় তৎকালীন মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদের জড়িত থাকার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আরও অনেকে এর মধ্যে জড়িত ছিল, এই ষড়যন্ত্রের সাথে। আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরের থেকে শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। সে সুযোগটা (তারা) করে দিয়েছিল।
বুধবার সকালে গণভবনে এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। সেই থেকে দিনটিকে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালন করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দিবসটি উপলক্ষে বুধবার আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা গণভবনে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। শুভেচ্ছা বিনিময়কালে প্রায় ৫২ মিনিটের বক্তব্যে ৭৫ পরবর্তী সময়ের স্মৃতিচারণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ছয় বছর প্রবাসে থাকার পর প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বাবার দল আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। তারপর এখন তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এছাড়া ১৯৮১ থেকে অদ্যবধি টানা ৩৬ বছর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
১৯৭৫ এর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, অনেকেই (বঙ্গবন্ধুকে) তাকে সাবধান করেছিলেন; এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বিশ্বাসই করেন নাই। আব্বা বলতেন, ‘না, ওরা তো আমার ছেলের মতো, আমাকে কে মারবে?’ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররাই জাতির জনককে হত্যা করেছিল, বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুক্যণা বলেন, এই হত্যাকান্ডে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের অনেকের নিয়মিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল। ডালিম (শরিফুল হক ডালিম), ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ, ডালিমের শ্যালিকা ২৪ ঘণ্টা আমাদের বাসায় পড়ে থাকত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুনি মেজর নূর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে কর্মরত ছিল। তখন আমার ভাই শেখ কামালও ওসমানীর এডিসি ছিলো। দুই জন এক সঙ্গে কর্মরত ছিল। তিনি বলেন, এরা তো অত্যন্ত চেনা মুখ। আরেক খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী এ আর মল্লিকের শ্যালিকার ছেলে। তিনি বলেন, খুব দূরের না। এরাই ষড়যন্ত্র করল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা আবারও বলেন শেখ হাসিনা। বলেন, যারা এভাবে বেইমানি করে, মোনাফেকি করে, তারা কিন্তু এভাবে থাকতে পারে না। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করে। তাদের মধ্যে অবশ্যই যোগসাজশ ছিল।
জিয়ার পারিবারিক সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ নেওয়ার কথাও তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান প্রতি সপ্তাহে একদিন তার স্ত্রীকে (খালেদা জিয়া) নিয়ে ওই ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেত। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দুয়ার সবার জন্য অবারিত ছিল, যার সুযোগ ষড়যন্ত্রকারীরা নিয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, তাদের যাওয়াটা আন্তরিকতা না.. চক্রান্ত করাটাই ছিল তাদের লক্ষ্য; সেটা বোধ হয় আমরা বুঝতে পারি নাই। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আব্বা যখন দেখেছেন, তাকে গুলি করছে, তারই দেশের লোক, তার হাতে গড়া সেনাবাহিনীর সদস্য, তার হাতে গড়া মানুষ.. জানি না তার মনে কী প্রশ্ন জেগেছিল?
স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণার কারণে ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই জার্মানিতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা; ছোট বোন শেখ রেহানাও সেখানে গিয়েছিলেন বেড়াতে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের দিন দুই বোন ছিলেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। খবর শোনার পর পশ্চিম জার্মানিতে ফিরে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় ওঠেন তারা। পরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
এক দিনে পরিবারের সবাইকে হারানোর দিনটি মনে করতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখনও ততটা জানতে পরিনি কী ঘটে গেছে বাংলাদেশে। যখন জানতে পারলাম, তখন সহ্য করাটা কঠিন ছিল। ওই সময় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের পশ্চিম জার্মানির বন শহরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের কথা চেপে যাওয়ার কথাও বলেন শেখ হাসিনা। বলেন, উনি এই হত্যাকান্ড সম্পর্কে একটা কথাও বললেন না। উনার কোথায় যাওয়ার কথা ছিল চলে গেলেন। হুমায়ুন রশীদ সাহেব এই হত্যাকান্ডকে কনডেম করলেন প্রেসের সামনে।
ভারতে নির্বাসিত জীবনের কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই শেখ হাসিনা বলেন, ভাবলাম দেশের কাছে যাই। কখনও শুনি, মা বেঁচে আছে। কখনও শুনি, রাসেল বেঁচে আছে। একেক সময় একেক খবর পেতাম। ওই আশা নিয়ে চলে আসলাম। কেউ বেঁচে থাকলে ঠিক পাব। ২৪ আগস্ট দিল্লি পৌঁছলাম। মিসেস গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধী) আমাদের ডাকলেন। ওনার কাছ থেকে শুনলাম, কেউ বেঁচে নেই। হুমায়ুন রশীদ সাহেব আগে বলেছিলেন। কিন্তু, আমি রেহানাকে বলতে পারি নাই। কারণ, ওর মনে একটা আশা ছিল, কেউ না কেউ বেঁচে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দিল্লিতে মিসেস গান্ধী থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ওয়াজেদ সাহেবকে (এম ওয়াজেদ মিয়া) এটমিক এনার্জিতে কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেখ হাসিনা বলেন, এটা কী কষ্টের .. যন্ত্রণার কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। অর্থের কারণে ১৯৭৭ সালে বোন শেখ রেহানার বিয়েতে লন্ডনে যেতে না পারার বেদনা তুলে ধরে তিনি বলেন, দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে যাব, অত টাকা ছিল না। আর, কোথায় থাকব?
১৯৮০ সালে লন্ডনে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বলেন, ওর (শেখ রেহানা) যখন বাচ্চা হবে, আমি মিসেস গান্ধীকে গিয়ে বললাম, আমি যেতে চাই রেহানার কাছে। উনি ব্যবস্থা করে দিলেন। টিকেটের ব্যবস্থা করে দিলেন। থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ৮০ এর শেষে দিল্লিতে ফিরে আসি। টাকাও ছিল না। আর, কার কাছে হাত পাতা.. ভালো লাগত না।
১৯৮০ সালে বিদেশে থাকার সময়ই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত করা হয় রাজনীতির বাইরে থাকা শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এত বড় সংগঠন করার অভিজ্ঞতাও আমার ছিলে না। আমার চলার পথ অত সহজ ছিল না।
দল এবং দলের বাইরে নানা প্রতিকূলতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, খুনিরা বহাল তবিয়তে বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত। স্বাধীনতার বিরোধীরা তখন বহাল তবিয়তে। তারাই ক্ষমতার মালিক। যে পরিবারকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো, সে পরিবারের একজন এসে রাজনীতি করবে। সেটা এত সহজ ছিল না, প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা ছিল।
বক্তব্যের এই পর্যায়ে উপস্থিত নেতাদের আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব খুঁজতে বলেন শেখ হাসিনা। বলেন, আজকে ৩৫ বছর পেরিয়ে ৩৬ বছরে পা দিলাম এই আওয়ামী লীগে। এত লম্বা সময় কেউ কখনো দায়িত্বে থাকে না। আমার মনে হয় আমাদেরও এখন নতুন নেতৃত্ব খোঁজা উচিত ভবিষ্যতের জন্য। তখন সবাই সমস্বরে ‘না না, যতোদিন বেঁচে আছেন আমরা আপনাকে চাই’ বলে ওঠেন নেতাকর্মীরা। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, নতুন নেতৃত্ব খোঁজা দরকার। জীবন-মৃত্যু আমি পরোয়া করি না। মৃত্যুকে আমি সামনে থেকে দেখেছি। আমি ভয় পাইনি। আমি বিশ্বাস করি, আমার আব্বা আমাকে ছায়ার মতো আমাকে দেখে রাখেন.. আর, উপরে আল্লাহর ছায়া আমি পাই।
৩৬ বছর আগের এই দিনটিতে দেশে ফেরার কারণ ব্যাখ্যা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বলেন, মেয়ের হাত ধরে দুটো সুটকেস নিয়ে চলে আসি। আমি মনে করি, আমাকে যেতে হবে, কিছু করতে হবে। তিনি বলেন, দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেছি। যেদিন স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পারবো সেইদিন আব্বার আত্মা শান্তি পাবে, আর ষড়যন্ত্রকারীদের উপযুক্ত জবাব দিতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আর ষড়যন্ত্রকারীরা ষড়যন্ত্র করে যাবে এটা আমি জানি। কারণ ছোট বেলা থেকে এটা আমাদের দেখা আছে। কাজেই ওটা আমি পরোয়া করি না। যতোক্ষন বাংলাদেশের জনগণ আমার সাথে আছে, ওপরে আল্লাহ আছেন, বাবা-মায়ের দোয়া আর্শিবাদ আছে। কাজেই আমরা আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবো। এই দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের আছে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে গণভবনের ব্যাংকুয়েট হলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, মাহবুব-উল আলম হানিফ, আব্দুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, এস এম কামাল হোসেন প্রমুখ ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রীকে। এছাড়া যুবলীগের পক্ষ থেকে সংগঠনের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ, ছাত্রলীগের পক্ষে সাইফুর রহমান সোহাগ, এস এম জাকির হোসাইন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের পক্ষে মোল্লা মো আবু কাওছার, পংকজ দেবনাথ, যুব মহিলা লীগের পক্ষে নাজমা আক্তারসহ আওয়ামী লীগের সকল সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের শীর্ষ নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে ফুলের শুভেচ্ছা জানান।
-আমাদের সময়
পাঠকের মতামত: